বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪
Online Edition

শেকড়-স্মৃতির ঢেউ 

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ : অনুষ্ঠানের প্রসংগটি এসেছিলো হঠাৎ করেই। ২০১৮ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে কলকাতায় গিয়েছিলাম উত্তর কলকাতা বাংলাভাষা চর্চাকেন্দ্র আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির জীবনানন্দ সভাঘরে ১ সেপ্টেম্বরে আয়োজন করা হয় ‘আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসব’। সেখানে বাংলাদেশ থেকে আমরাও আমন্ত্রিত ছিলাম। আমরা মানে কথাশিল্পী নাজিব ওয়াদুদ, কবি ও গবেষক ড. ফজলুল হক তুহিন এবং আমি মাহফুজুর রহমান আখন্দসহ আরো কয়েকজন। বেশ জমজমাট অনুষ্ঠান। আলোচনা, গান, কবিতায় ভীষণ মুনোমুগ্ধকর ছিলো জীবনানন্দ সভাঘর। কবি জয়ন্ত রসিক, গল্পকার শেখ আবদুল মান্নান, চোখ সম্পাদক মানিক দে, সুলেখক বদরুদ্দোজা হারুন প্রমুখ ছিলেন আয়োজকগণের অন্যতম। সাহিত্যেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সেখানে আমাদের পুরষ্কারও দেয়া হলো। অনুষ্ঠানে অতিথিগণের মধ্যমণি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী শতবর্ষী বুদ্ধিজীবী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য। ভীষণ খোলামনের মানুষ তিনি। আমাদের পেয়ে গল্প জমিয়ে তুললেন। রীতিমত আড্ডার পরিবেশ। রাজশাহীর প্রসঙ্গ আসতেই তিনি খুশিতে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন, আমি রাজশাহী যাবো, তোমরা ব্যবস্থা করো। আমরা আমন্ত্রণ জানালাম। 

কবি ও নাট্যব্যক্তিত্ব জয়ন্ত রসিক উত্তর কলকাতা বাংলাভাষা চর্চাকেন্দ্রের সভাপতি। কিছুদিন পরেই তিনি জানালেন, আমরা আসছি বাংলাদেশে। পূর্ণেন্দু মহাশয়ও আসবেন। বললাম, কিভাবে? তিনি জানালেন আমাদের বঙ্গসাহিত্য সম্মিলনের ৬৯তম সাহিত্য অধিবেশন এবার বাংলাদেশে হবে; এবং ভেন্যু হবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আপনারা আয়োজনের ব্যবস্থা করুন। আমরাও খুশি হয়ে সম্মতি জানালাম।

বঙ্গসাহিত্য সম্মিলনের ৬৯তম অধিবেশন

বঙ্গসাহিত্য সম্মিলন অনেক প্রাচীন সংগঠন। সম্ভবত ১৩১৪ বঙ্গাব্দে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে এ সংগঠনের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সংগঠনের ৬৯তম সাহিত্য অধিবেশন রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত হবেÑ এটা অবশ্যই আনন্দেও খবর বৈকি। অবশেষে হলো। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন সংগঠন ‘বঙ্গসাহিত্য সম্মিলন’ এর ৬৯তম সাহিত্য অধিবেশন এবার বাংলাদেশের রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত হলো।

২০১৯ সালের বিদায়ী দিন, ৩১ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস কমপ্লেক্স কনফারেন্স হলে এ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনায় ছিলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য সংগঠন শব্দকলা। ‘বঙ্গসাহিত্য সম্মিলন’ এর সভাপতি ভারতের পাঁচজন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননাপ্রাপ্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্যের সভপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনটি উদ্বোধন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফজলুল হক। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাবি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, নাট্যব্যক্তিত্ব জয়ন্ত রসিক, ড. শিশুতোষ সামন্ত, কবি গোপাল চক্রবর্তী, কথাশিল্পী নাজিব ওয়াদুদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন শব্দকলাপ্রধান প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ। 

বক্তাগণ বলেন, বাংলাদেশ এবং ভারত আলাদা দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হলেও ভাষাগত ঐক্য আমাদের চিন্তাচেতনাকে কাছাকাছি করে রাখে। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিসংগ্রামের জন্য আমরাও গর্ববোধ করি। নানামুখি আগ্রাসনে আক্রান্ত হলেও বাংলাভাষার সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে দুই দেশের লেখকদেরকেই আন্তরিকভাবে কাজ করে যেতে হবে।

অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ড. দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. মনোরোমা পোল্ল্যে, জয়া সান্যাল, কথাশিল্পী দেওয়ান মোহাম্মদ শামসুজ্জামান, কবি মনজু রহমান, ড. ফজলুল হক তুহিন, ড. রুমী শাইলা শারমিন, কবি আলমগীর কবির হৃদয় প্রমুখ। অনুষ্ঠানে ভারতের ২১জন কবি-সাহিত্যিকসহ দেড়শতাধিক লেখক-সাহিত্যিক উপস্থিত ছিলেন। অতিথিবৃন্দসহ লেখাপাঠে অংশ নেন কবি অসিত রঞ্জন দাশ, সাবিত্রী কাহালী, দীপেন ভাদুড়ি, তাপস সাহা, সবিতা বেগম, রথীন্দ্রনাথ বসাক, শঙ্খ ভট্টাচার্য, মুকুল কেশরী, মুহাম্মদ শরিফউদ্দিন, শিরিন শরীফ, এ বি সিদ্দিকী, জামাল দ্বীন সুমন, এরফান আলী এনাফ, শাহানা ইয়াসমিন মুক্তা, শেখ তৈমুর আলম, নাহিদা আকতার নদী, জসিম উদ্দিন বিজয়, দীননাথ চক্রবর্তী, অনিন্দিতা পাল, দীপক রঞ্জন কর, বাসুদেব দাস, কামাক্ষা রঞ্জন দাস, রণেন্দ্র ধাড়া, অশোক কাহালী প্রমুখ।

সফিউদ্দীন মোল্লা ভাসানী রচনাবলীর মোড়ক উন্মোচিত

অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিলো প্রাবন্ধিক, কবি ও কথাশিল্পী সফিউদ্দীন মোল্লা ভাসানী রচনাবলীর মোড়ক উন্মোচন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস কমপ্লেক্স কনফারেন্স হলে ঐদিন বেলা ১২টায় মোড়ক উন্মোচিত হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য সংগঠন শব্দকলার আয়োজনে এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শব্দকলাপ্রধান প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ। অতিথি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য, রাবি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, নাট্যব্যক্তিত্ব জয়ন্ত রসিক, ড. শিশুতোষ সামন্ত, কবি গোপাল চক্রবর্তী, কথাশিল্পী নাজিব ওয়াদুদ,  ড. দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. মনোরোমা পোল্ল্যে, জয়া সান্যাল, কথাশিল্পী দেওয়ান মোহাম্মদ শামসুজ্জামান, কবি মনজু রহমান, ড. ফজলুল হক তুহিন, ড. রুমী শাইলা শারমিন, কবি আলমগীর কবির হৃদয়, ভাসানী তনয়া নাসরিন সুলতানা ইতি, জামাতা আশফাকুল হক প্রমুখ। ।

বক্তাগণ বলেন, সফিউদ্দীন মোল্লা ভাসানী একজন ভাষাসংগ্রামী, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সুলেখক। তাঁর গল্পে নিজ জেলা নওগাঁর শুধু নয়, সারা বাংলাদেশের যেমন সমাজবাস্তবতার বিষয়সমূহ উঠে আসে তেমনি প্রবন্ধের মাধ্যমেও সমাজের অসঙ্গতিসমূহ চিত্রিত হয়। তাঁর মতো একজন প্রবীণ ব্যক্তির রচনাবলী প্রকাশ সময়ের দাবী ছিলো। রাজশাহীর পরিলেখ প্রকাশনী সে দায়িত্ব পালন করায় পরিলেখ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানানো হয়। 

অনুষ্ঠান শেষ করে বিকেলে যাওয়া হয় নাটোর রাজবাড়ি ভ্রমণে। বিনোদপুর বাজারেই সন্ধ্যা হয় হয়। রাজবাড়ির গেট দর্শনার্থীর জন্য বন্ধ হয়ে যাবে জেনে অনেকেই সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে অনাগ্রহী হয়ে উঠলেন। কিন্তু শতবর্ষী জীবনসংগ্রামী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন। বললেন, ‘সিদ্ধান্ত হয়েছে, যাবো। খোলা না থাকলে ফিরে আসবো। সফলতা ব্যর্থতার কথা পরে। আগে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন। আমি কখনো সিদ্ধান্তের অমর্যাদা করি না।’ সবাই বিনাবাক্যে চলে গেলাম। নাটোর রাজবাড়ি তাঁর পিসির বাড়ি। সেখানে গিয়ে তিনি দারুণভাবে আপ্লুত হলেন। রাত হওয়া সত্ত্বেও সবাই সব দরোজা খুলে দিলেন দেখার জন্য। অনেকেই এসে ভিড় জমালেন। অবশেষে ফিরে এলাম রাজশাহীতে। তাঁর কথাটি এখনো কানে বাজেÑ ‘আমি সিদ্ধান্তের অমর্যাদা করি না। সিদ্ধান্ত হয়েছে, যাবোই।’ ফিরে এসে আমি তাঁকে বললাম, এজন্যই আপনি স্বাধীনতা সংগ্রামী।

পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্যকে পরিচয় আজীবন সম্মাননা প্রদান 

২০২০ সালের সূচনা হলো। পহেলা জানুয়ারি সকালে প্রোগ্রাম ছিলো নওগাঁ বলিহার রাজবাড়ি। ওখানে পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্যের বোনের বিয়ে হয়েছিলো। বাস রিজার্ভ করে আমরা সেখানে গেলাম। কথাসাহিত্যিক দেওয়ান মোহাম্মদ শামসুজ্জামান আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তাঁর ভাই দেওয়ান মোহাম্মদ খায়রুল আনাম, দেওয়ান ইকরামুল আলী এবং দেওয়ান ইখতিয়ার হাসানসহ অনেকেই ভীষণ আন্তরিক ছিলেন আয়োজনে। সেখানে পৌঁছে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। শতশত মানুষ ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। হিন্দু-মুসলিম নারী-পুরুষ, শিশু জমায়েত হয়েছেন সেখানে। অভূতপূর্ব এক দৃশ্য। তিনিও আপ্লুত হলেন। বললেন, ‘বাংলাদেশ আমারও দেশ। আমার জন্মভূমি।’ ময়মনসিংহ গৌরিপুর জমিদার বাড়ির সন্তান ছিলেন তিনি। বলিহার থেকে ফিরে বিকেলে তাঁকে ‘পরিচয় আজীবন সম্মাননা’ দেয়া হয়। রাজশাহীস্থ পরিচয় মিলনায়তনে তাঁকে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়। কথাশিল্পী নাজিব ওয়াদুদ’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পরিচয় সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি কবি ও গবেষক প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ। অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব জয়ন্ত রসিক, ড. শিশুতোষ সামন্ত, কবি গোপাল চক্রবর্তী, ড. দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. মনোরোমা পোল্ল্যে, জয়া সান্যাল, কথাশিল্পী দেওয়ান মোহাম্মদ শামসুজ্জামান, কবি খুরশীদ আলম বাবু, শিশুসাহিত্যিক আসাদুল্লাহ মামুন প্রমুখ। ।

অনুষ্ঠানে অতিথিবৃন্দসহ লেখাপাঠে অংশগ্রহণ করেন কবি অসিত রঞ্জন দাশ, সাবিত্রী কাহালী, দীপেন ভাদুড়ি, তাপস সাহা, সবিতা বেগম, রথীন্দ্রনাথ বসাক, শঙ্খ ভট্টাচার্য, জসিম উদ্দিন বিজয়, দীননাথ চক্রবর্তী, অনিন্দিতা পাল, দীপক রঞ্জন কর, বাসুদেব দাস, কামাক্ষা রঞ্জন দাস, রণেন্দ্র ধাড়া, অশোক কাহালী, কবি ফারহানা শরমীন জেনী, আল মারুফ, ইমরান আজিম, ইমরান সাজিদ, সালেকুর রহমান স¤্রাট প্রমুখ।

২ জানুয়ারি ভোরবেলা বিদায়ের পালা। কবি তাপস সাহা চারজনের প্রতিনিধি দল নিয়ে ছুটলেন সাগরদাঁড়ি ট্রেনে। দর্শনা হয়ে তিনি চললেন সরাসরি কলকাতার পথে। বাকী সতেরো সওয়ার কুষ্টিয়ার পথে। কুষ্টিয়ার সংস্কৃতিবন্ধুদের জানালাম। আমরা বিদায় দিলাম, তারা ওখানে স্বাগত জানিয়ে কুঠিবাড়ি, লালন সাঁইয়ের মাজার দেখিয়ে পরের দিন পাঠিয়ে দিলেন কলকাতার পথে। শুধু পূর্ণেন্দু মহাশয় এবং তাঁর সুযোগ্যপুত্র শঙ্খ ভট্টাচার্য গৌরীপুর যাবেন। আমি ময়মনসিংহ অঞ্চলের সংস্কৃতিবন্ধুদের হাতে তুলে দিলাম। নিজবাসভবন পরিদর্শন শেষে তিনি চলে গেলেন কলকাতায়। এ আয়োজনে অনুপ্রেরণার একটি স্মৃতি মাথায় আজও ঘুরে বেড়ায়Ñ আমি সিদ্ধান্তের অমর্যাদা করি না। সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগে বাস্তবায়ন, তারপরে পর্যালোচনা।’ অসাধারণ এক দৃঢ়চেতা মনোবল। আমার বাসায় আমার সন্তানদের যে ভালোবাসা তাঁরা দিয়ে গেছেন, ওরাও হয়তো ভুলতে পারবে না কখনো। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ